সুন্দরবনে বারবার আগুন লাগে কেন?

Daily Inqilab ইনকিলাব

০৭ মে ২০২৪, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ০৭ মে ২০২৪, ১২:০৮ এএম

সুন্দরবনে আগুন লেগে প্রায় ১০ একর এলাকার ছোট ছোট গাছপালা ও তৃণলতা পুড়ে গেছে। পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের যে এলাকায় আগুন লাগে, সেখানে পশু-পাখির বিচরণ বেশি। আগুনে পশু-পাখির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কিনা, জানা যায়নি। শনিবার সকালে লাগা আগুন ৩০ ঘণ্টা পর রোববার বিকালে নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। সুন্দরবনে আগুন এই প্রথম লাগেনি। এর আগেও বিভিন্ন সময় এই বনের নানা এলাকায় আগুন লেগেছে। গাছপালা, তৃণলতা, কীটপতঙ্গের ক্ষতি হয়েছে। পশু-পাখি আবাস হারিয়েছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক খবরে জানানো হয়েছে, গত ২৩ বছরে সুন্দরবনে অন্তত ২৫ বার আগুন লেগেছে। অন্য এক পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, ২০ বছরের ২৫টি অগ্নিকাণ্ডে কমপক্ষে ৮৬ একর বন পুড়ে গেছে। শুল্ক মওসুমে (মার্চ-মে) অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। লক্ষ করার বিষয়, প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পর বন বিভাগের তরফে অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি যথাসময়ে রির্পোট দিয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের কারণ উল্লেখ করেছে এবং অগ্নিকাণ্ড রোধে সুপরিশ পেশ করেছে। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, অগ্নিকাণ্ডের কারণ প্রতিরোধে ও সুপারিশ বাস্তবায়নে কোনো কার্যকর উদ্যোগই নেয়া হয়নি। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এ ব্যাপারে যথোচিত পদক্ষেপ নেয়া হলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এত বেশি ঘটতো না। দখল, দূষণ, অগ্নিকাণ্ড, বৃক্ষনিধনসহ নানা অনাচারে সুন্দরবনের আকার-আয়তন অনেক কমে গেছে। সুন্দরবনের অস্তিত্ব কার্যত বিপন্ন হয়ে পড়েছে। সুন্দরবন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন। জীব-জন্তু, পাখ-পাখালিসহ বিভিন্ন প্রাণির আশ্রয়স্থল হিসাবে এর ভূমিকা বিপুল। শত শত বছর ধরে সুন্দরবন সাগরের ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও তাণ্ডব থেকে দেশকে সুরক্ষা দিয়ে আসছে। দেশের অস্তিত্ব রক্ষার কাজ করছে। অশেষ সম্পদের আধার এই বন। লাখ লাখ মানুষ জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছে এই বন থেকে। সুন্দরবন এদেশের মানুষের অনিবার্য বান্ধবই শুধু নয়, বিশ্ব ঐতিহ্য হিসাবেও স্বীকৃত। যে কোনো মূল্যে সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এর বিকাশ বিস্তৃতি নিশ্চিত করতে হবে।

সুন্দরবনকে আমরা যথাযথ মূল্যায়ণ করছি না। তার প্রতি আমাদের অবহেলা অপার, অশেষ। বন স্বাভাবিক কারণেই বাড়ার কথা। সুন্দরবন ব্যাতিক্রম, না বেড়ে, কমছে। এটা খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ যখন ছোট হয়ে যাচ্ছে তখন ভারতীয় অংশ বাড়ছে। সুন্দরবনের বিখ্যাতির অন্যতম উপলক্ষ রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও দুলর্ভ চিত্রল হরিণ। অথচ এই বাঘ ও হরিণের সংখ্যা কমতে কমতে একটা প্রান্তিক ও বিপজ্জনক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। বাঘ ও হরিণের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হলেও কীভাবে তাদের সংখ্যা বাড়বে, তার কোনো পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নেই। খবর হলো, বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা যখন কমছে তখন ভারতের অংশে বাড়ছে। হরিণের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ভারতের অংশে এই বাড়বাড়ন্ত কেন? পর্যবেক্ষকদের মতে, বন বাড়ানো ও বনের যত্ন নেয়ার দিকে ভারতের বন বিভাগের তীক্ষ্ন নজর রয়েছে। এনিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প-পরিকল্পনা আছে তার। আছে উপযুক্ত পরিচর্যা। একইভাবে জীব-জন্তু, পাখ-পাখালির দেখভাল ও তাদের খাদ্য সংস্থানের বন্দোবস্ত আছে। দখল, দূষণ, অনাচার প্রতিরোধের ব্যবস্থা আছে। আমরা সুন্দরবনের পাশে বিদ্যুৎকেন্দ্র ও শিল্পকারখানা স্থাপন করেছি। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে তেলবাহী জাহাজ চলাচলের অনুমতি দিয়েছি। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো সুন্দরবনের পাশে বিদ্যুৎকেন্দ্র- শিল্পকারখানা স্থাপন ও তেলবাহী জাহাজের যাতায়াত বন্ধ করার লাগাতার দাবি জানিয়েও সফল হয়নি। এই সঙ্গে যোগ হয়েছে দখল। বন কেটে সাফ করে অন্যান্য কাজে সেই জমি ব্যবহার করছে প্রভাবশালীরা। সত্যি বলতে কি, আমরা চারদিক থেকে সবাই মিলে সুন্দরবনকে হত্যা করে চলেছি। এ ব্যাপারে কারো সচেতনতা নেই। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নেই। এটা অত্যন্ত ভয়ংকর এক বাস্তবতা।

সুন্দরবন না থাকলে আমাদের এই দেশ ও দেশের মানুষের ভবিষ্যত কী হবে, সেটা আমরা মোটেই ভেবে দেখছি না। আইলা-সিডর উপকূলে ধ্বংস ও তাণ্ডব দেখিয়েছে। তার মোকাবিলায় সুন্দরবন বুক পেতে আমাদের সুরক্ষা দিয়েছে। সুন্দরবন না থাকলে এরকম ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস আমাদের ভূমি-জনপদ বিলীন করে দেবে এবং আমাদের পথে বসিয়ে ছাড়বে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি বিরূপ প্রভাব পড়া দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে আবহাওয়ায় উত্তাপ ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমাগত বাড়বে। সেক্ষেত্রে অন্যান্য প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের উপকূলীয় এলাকাসহ অনেক জনপদ সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে যাবে। এহেন আশংকার প্রেক্ষিতে সুন্দরবনকে আরো বিস্তৃত ও সুগঠিত করা যেখানে অপরিহার্য, সেখানে তাকে নিশ্চহ্ন করার আত্মঘাতী কর্মে আমরা লিপ্ত হয়ে পড়েছি। সুন্দরবনে বারবার আগুন লাগার বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। নিতান্তই অসচেতনতার অভাব, নাকি এর পেছনে কারো নাশক ইচ্ছার ভূমিকা আছে, সেটা নির্ণয় করা জরুরি। ইতোপূর্বে বনবিভাগের তদন্তকারিরা অগিকাণ্ডের যে সব কারণ উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে মাছ শিকারী ও মৌয়ালদের কাজের জন্য ব্যবহৃত আগুন, তাদের ফেলে দেয়া বিড়ি-সিগারেটের আগুন ইত্যাদিই প্রধান। এক্ষেত্রে মাছ শিকারী, মধু আহরণকারী, কাঠ ও গোলপাতা সংগ্রহকারীদের বিশেষভাবে সাবধান ও সতর্ক করা হলে আগুন লাগার ঘটনা কমতে পারে। নাশকতার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। কারণ, সুন্দরবনের শত্রুর অভাব নেই। তদন্তকারীরা বনসীমান্তে বেড়া, ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ ও মরে যাওয়া খাল-নদী খননের যে সুপারিশ করেছেন, তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। বাস্তবায়ন হওয়া আবশ্যক। বর্তমান বন ও পরিবেশ মন্ত্রী তার দায়িত্বের ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক ও সচেতন। আমরা আশা করবো, তিনি সুন্দরবন সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ অবিলম্বে গ্রহণ করবেন।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

সঠিক ওজন ও পরিমাপ নিশ্চিতকরণে বিএসটিআই নিরলস কাজ করে যাচ্ছে : প্রধানমন্ত্রী

সঠিক ওজন ও পরিমাপ নিশ্চিতকরণে বিএসটিআই নিরলস কাজ করে যাচ্ছে : প্রধানমন্ত্রী

কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত সাবেক বিজেপি নেতা

কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত সাবেক বিজেপি নেতা

খালেকুজ্জামানের বাড়ী সরকারিভাবে পুননির্মাণের দাবি - ইসলামী মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ

খালেকুজ্জামানের বাড়ী সরকারিভাবে পুননির্মাণের দাবি - ইসলামী মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রগঠনের দাবিতে সারাদেশে জেলা ও মহানগরীতে ইসলামী

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রগঠনের দাবিতে সারাদেশে জেলা ও মহানগরীতে ইসলামী

স্বাচিপ রাজশাহী জেলা শাখার সভাপতি ডা. জাহিদ, সম্পাদক ডা. অর্ণা জামান

স্বাচিপ রাজশাহী জেলা শাখার সভাপতি ডা. জাহিদ, সম্পাদক ডা. অর্ণা জামান

রাজশাহীতে মোটরসাইকেলের কাগজপত্র দেখতে চাওয়ায় পুলিশকে মারপিট, যুবক আটক

রাজশাহীতে মোটরসাইকেলের কাগজপত্র দেখতে চাওয়ায় পুলিশকে মারপিট, যুবক আটক

যৌথ বাহিনীর অভিযানে বান্দরবানে কেএনএফের ৩ সদস্য নিহত

যৌথ বাহিনীর অভিযানে বান্দরবানে কেএনএফের ৩ সদস্য নিহত

ফতুল্লায় হত্যা মামলার আসামি কেরানিগঞ্জে গ্রেপ্তার

ফতুল্লায় হত্যা মামলার আসামি কেরানিগঞ্জে গ্রেপ্তার

মলদোভায় জীবন্ত অবস্থায় বৃদ্ধকে কবর, চারদিন পর উদ্ধার

মলদোভায় জীবন্ত অবস্থায় বৃদ্ধকে কবর, চারদিন পর উদ্ধার

ফেনীতে বজ্রপাতে প্রাণ হারাল শিক্ষার্থী

ফেনীতে বজ্রপাতে প্রাণ হারাল শিক্ষার্থী

সামাজিক সুরক্ষার সুবিধাভোগী বাছাইয়ে অনিয়ম হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে -ডা. দীপু মনি

সামাজিক সুরক্ষার সুবিধাভোগী বাছাইয়ে অনিয়ম হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে -ডা. দীপু মনি

ব্রিটেনে ধনকুবেরদের তালিকায় শীর্ষে হিন্দুজা, রাজাকে টপকালেন সুনাক!

ব্রিটেনে ধনকুবেরদের তালিকায় শীর্ষে হিন্দুজা, রাজাকে টপকালেন সুনাক!

মেরিনড্রাইভ সড়কে মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে দুইজন নিহত

মেরিনড্রাইভ সড়কে মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে দুইজন নিহত

ইসরাইলে বিস্ফোরক পাঠাচ্ছে ভারত! অস্ত্র বোঝাই জাহাজ আটকাল স্পেন

ইসরাইলে বিস্ফোরক পাঠাচ্ছে ভারত! অস্ত্র বোঝাই জাহাজ আটকাল স্পেন

পায়রা বন্দরের সঙ্গে সড়ক ও রেলের কানেকটিভিটি বাড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ

পায়রা বন্দরের সঙ্গে সড়ক ও রেলের কানেকটিভিটি বাড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ

কাশ্মীরে ফারুক আবদুল্লার সভায় ছুরি হাতে তাণ্ডব আততায়ীর

কাশ্মীরে ফারুক আবদুল্লার সভায় ছুরি হাতে তাণ্ডব আততায়ীর

ইতালি কি ইথিওপিয়াকে ঔপনিবেশিক শোষণের ক্ষতিপূরণ দেবে?

ইতালি কি ইথিওপিয়াকে ঔপনিবেশিক শোষণের ক্ষতিপূরণ দেবে?

সরকার নানা কায়দায় বিরোধী নেতাকর্মীদের নির্যাতন শুরু করেছে: মির্জা ফখরুল

সরকার নানা কায়দায় বিরোধী নেতাকর্মীদের নির্যাতন শুরু করেছে: মির্জা ফখরুল

কালশীতে রিকশাচালক-পুলিশের সংঘর্ষে পথচারী গুলিবিদ্ধ

কালশীতে রিকশাচালক-পুলিশের সংঘর্ষে পথচারী গুলিবিদ্ধ

ইউরোপিয়ান সোশ্যাল বিজনেস ট্যুরে প্রফেসর ইউনূস

ইউরোপিয়ান সোশ্যাল বিজনেস ট্যুরে প্রফেসর ইউনূস